নিজস্ব প্রতিনিধি: ১৯৭৩ সালের পর থেকে প্রায় ৫০ বছর রাজশাহী-২ আসনে সংসদ নির্বাচনে কোনোদিন নৌকা জয়ের মুখ দেখতে পায়নি। পুরো সময়টাতেই এখানে জয়জয়কার ছিলো বিএনপির। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫০ বছর পর ফজলে হোসেন বাদশার হাত ধরে প্রথম এই আসনে নৌকা জয় পায়। এরপর থেকে টানা তিনবার তিনি নৌকার কাণ্ডারি হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশের নৌকা-বিরোধী অবস্থান এই আসন নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।
সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি। সেই নির্বাচনে কমিউনিস্ট লীগের প্রার্থী হিসেবে ফজলে হোসেন বাদশা ৩৪ হাজার ২৬৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। ২০০২ সালের সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনুর বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নামা রাকসুর সাবেক ভিপি বাদশার সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য ঐক্য তৈরি হয়। ওই নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে বাদশা হারলেও অভিযোগ ওঠে, বিএনপি কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল বদলে দিয়েছে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হলে ২০০৮ সালে ৫০ বছর পর প্রথমবারের মতো বাদশার হাত ধরেই এই আসনে নৌকা বিজয়ী হয়।
কিন্তু এবার শুরু থেকেই মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশ ফজলে হোসেন বাদশাকে নৌকার প্রার্থী করার বিরোধিতা করে আসছে। যদিও রাজশাহী-২ নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে গিয়ে ভোটারদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হচ্ছে ওইসব আওয়ামী লীগ নেতাদের। বিশেষ করে, দলের নেতা হয়ে কীভাবে ও কী কারণে তারা দলের প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করছেন, সেই প্রশ্নটি বারবার শুনতে হচ্ছে তাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের জবাবে সন্তুষ্ট হচ্ছেন না ভোটাররা।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের বোয়ালিয়া পূর্ব শাখার সহ-সভাপতি আলাল পারভেজ লুলু গত মঙ্গলবার তার অনুগত নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘নৌকা’র বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোটের প্রচারণায় যান শিরইল এলাকায়। সেখানকার আওয়ামী লীগ সমর্থক এক পরিবারের কাছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে তিনি ভোট চাইলে তারা জানতে চান, নৌকার পক্ষে কেন তারা ভোট চাইছেন না? লুলু ও তার সঙ্গের লোকজন তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা, তাই এবার তাকে ভোট দিতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই পরিবারটি এসব যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়নি।
শিরইল এলাকার ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা জানান, এসব নেতাদের কথাবার্তা তাকে চিন্তায় ফেলেছে। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ‘ভাল্লাগছে না যে, ক্যারে আমার আব্বা ছিলো নৌকা। নৌকা নিয়ে দাঁড়াবে। তা, সেই আব্বার নৌকা গেলো কোথায়? কী কয় এগুলা? কেঁচিতে ভোট দেবো, নৌকা কই? এহানে যারা সব নেতা ফেতা আছে তারা সব কচ্ছে যে দাও, এডাও শেখ হাসিনার। আমি কই যে শেখ হাসিনার কেন হবে এডা? আমার আব্বা যেডায় ছিলো, সেই নৌকায় আমি দেখবো।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নিয়ে গঠিত রাজশাহী-২ আসনে ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তার বিপক্ষে ‘কেঁচি’ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাজশাহী কোর্ট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বয়ং হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক। অন্যদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ দলের একটি অংশ রয়েছে নৌকার পক্ষে। এ নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচার চালাচ্ছেন, এমন একাধিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এই বিভাজন দলীয় প্রতীকের প্রতি নেতাকর্মীদের ভালোবাসাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা সবাই জানিয়েছেন, একজন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার চাপের মুখেই তারা নৌকার পক্ষে কাজ করতে পারছেন না।
তবে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী কামাল দাবি করেছেন, কারো চাপে নয়, স্থানীয় নেতাকর্মীরাই ফজলে হোসেন বাদশাকে চায় না। সে কারণে তাদের অবস্থান স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। তিনি বলেন, ‘নৌকা তো আমাদের দলের লোক পায়নি। সে কারণে নৌকার জন্য যে আমাদেরকে কাজ করতেই হবে, সেটার তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’
যদিও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের দাবি, যে যত কথাই বলুক, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা নৌকার পক্ষেই আছেন। তিনি বলেন, ‘নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, সেটা সঙ্গত কারণেই দিয়েছেন। নেত্রী বলেও দিয়েছেন, নৌকার পক্ষে দলের লোকজনকে কাজ করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো নেত্রীর নির্দেশ মানা। আমরা সেটাই করছি।’ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামা দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
’কেঁচি’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কলেজ শিক্ষক সমিতির সাবেক নেতা শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ‘এখানে যাকে নৌকা দেয়া হয়েছে, তাকে আমরা দলের লোকজন চাই না। নেত্রী যে কেন তাকে এবারও নৌকা মার্কায় মনোনয়ন দিলেন, সেটা জানি না। কিন্তু আমরা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে আমাদের প্রার্থী বলে মানছি না। এখানে আমিই রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
এ ব্যাপারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘আমাদের ১৪ দলীয় জোটের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই জায়গা থেকেই আমরা একত্রে লড়াই সংগ্রাম ও নির্বাচন করি। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন। আমি ভোটের কাজ করে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আমার সঙ্গেই আছেন। তারা আমার পক্ষেই কাজ করছেন।’ তার বিপক্ষে যারা কাজ করছেন তাদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।